মাত্র ১৩ বছর বয়সে জাতীয় দলে অভিষেক হয়েছিল মারিয়া মান্দার। ২০১৬ সালের শিলং এসএ গেমসে ব্রোঞ্জজয়ী বাংলাদেশ নারী ফুটবল দলের সদস্য ছিলেন তিনি। জাতীয় দলের পাশাপাশি বয়সভিত্তিক অনূর্ধ্ব-১৪, অনূর্ধ্ব-১৬ ও অনূর্ধ্ব-১৯ দলে মোট ৩০ ম্যাচ খেলেছেন এই মেধাবী মিডফিল্ডার।
নয় বছরের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে মঙ্গলবারের ম্যাচটি ছিল জাতীয় দলের জার্সিতে মারিয়ার ৪৫তম। আর এই ম্যাচেই এলো তার প্রতীক্ষিত প্রথম গোল—তাও আবার এক কথায় অসাধারণ। আজারবাইজানের বিপক্ষে ঢাকা জাতীয় স্টেডিয়ামে পাওয়া এই দর্শনীয় ভলি কেবল তাকে আলোচনায়ই নিয়ে আসেনি, দেশের নারী ফুটবলে যোগ করেছে নতুন ইতিহাসও।
ইউরোপীয় কোনো দলের বিপক্ষে বাংলাদেশের নারী ফুটবল দলের এটিই ছিল প্রথম ম্যাচ। ১৯ মিনিটে পিছিয়ে পড়ার পর ৮৩ মিনিটে মারিয়ার সেই চমৎকার গোলেই ম্যাচে ফিরেছিল বাংলাদেশ। স্বপ্না রানীর কর্নার ক্লিয়ার করতে গিয়ে আজারবাইজান গোলরক্ষক বলটি ফিস্ট করেন। বক্সের মাথায় দাঁড়ানো মারিয়া বাম পায়ের জোরালো ভলিতে বল জালে পাঠান, যা ডিফেন্ডার ও গোলরক্ষকের মাথার ওপর দিয়ে চলে যায় লক্ষ্যে।
গ্যালারি তখন ম্যাচ ড্রয়ের অপেক্ষায়; ঠিক সেই সময়ই ৮৩ মিনিটে গোল করে বসে অতিথিরা। ফলে ইউরোপীয় দলের বিপক্ষে অভিষেক ম্যাচটি শেষ হয় বাংলাদেশ নারী দলের ২-১ গোলে পরাজয়ে। তবে পরাজয় ছাপিয়ে আলোচনায় ছিলেন শুধু এক নাম—মারিয়া মান্দা। ম্যাচ শেষে টিম বাস যখন স্টেডিয়াম ছাড়ছিল, গণমাধ্যমকর্মীদের ভিড় ছিল তার প্রতিক্রিয়ার অপেক্ষায়।
ম্যাচ শেষে পাঁচ দিনের ছুটি পেয়েছে দল। বুধবারই মারিয়া ফিরে গেছেন ময়মনসিংহের কলসিন্দুরে, মায়ের কাছে। সেখান থেকেই তিনি বললেন—
“বিকেলে বাড়িতে ফিরলাম। কয়েকদিন বিশ্রাম নেবো, মায়ের রান্না খাবো। তারপর আবার ক্যাম্পে ফিরে যাব।”
প্রথম গোল উদযাপনে বাড়ি ফিরলেও মায়ের বিশেষ রান্নার ব্যাপারে মারিয়া জানালেন—
“এখনো মাকে জিজ্ঞেস করিনি। এইমাত্রই তো এলাম।”
২০১৬ সালে জাতীয় দলে অভিষেকের পর মারিয়া কখনো দলচ্যুত হননি। শুধু চাইনিজ তাইপের বিপক্ষে দুইটি ফিফা ফ্রেন্ডলি ম্যাচে ইনজুরির কারণে খেলতে পারেননি, আর সর্বশেষ সাফে পাকিস্তানের বিপক্ষে ছিলেন বদলি।
“বাকি সব ম্যাচেই আমি একাদশে খেলেছি,” বললেন আত্মবিশ্বাসী এই মিডফিল্ডার।
নিজের প্রথম আন্তর্জাতিক গোলের অনুভূতি জানাতে গিয়ে বলেন—
“ভলি করার পর মনে হচ্ছিল বলটি ক্রসবারের ওপর দিয়ে যাবে। কিন্তু তাকিয়ে দেখি বল জালের ভেতর! প্রথম গোল, তাও ইউরোপীয় দলের বিরুদ্ধে—অসাধারণ লাগছিল।”
অল্প বয়সে বাবাকে হারানো মারিয়া বড় হয়েছেন মায়ের কঠিন পরিশ্রমে। মা এনোতা মান্দা অন্যের জমিতে কাজ করে সংসার চালিয়েছেন। বয়সভিত্তিক দলের সাফল্যের পুরস্কার হিসেবে পাওয়া টাকা দিয়ে মারিয়া কিনেছিলেন ১২ কাঠা জমি ও ঘর মেরামত করেছিলেন।
“মাকে কাজ না করতে নিষেধ করি। তবুও মাঝে মাঝে যান। হয়তো কাজ ছাড়া থাকতে পারেন না,” বললেন মারিয়া।
তার ফুটবলে আসার গল্পটাও অনুপ্রেরণাদায়ক।
“২০১১ সালে প্রথম ফুটবল খেলি প্রাথমিক বিদ্যালয় গোল্ডকাপে। মফিজ স্যার ডাকছিলেন—কে ফুটবল খেলবে? আমিও হাত তুলেছিলাম। ঢাকা বিভাগে দুইবার চ্যাম্পিয়ন হই। ২০১৩ সালে প্রথম ট্রফি জিতি। পরের বছর পাই অনূর্ধ্ব-১৪ দলে সুযোগ। নেপালে এএফসি অনূর্ধ্ব-১৪ রিজিওনাল চ্যাম্পিয়নশিপ ছিল আমার প্রথম আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট। শুরু করেছিলাম ডিফেন্ডার হিসেবে, এখন মিডফিল্ডে খেলছি। আর প্রথমবার অধিনায়কত্ব পেয়েছি—যা আমার জন্য গর্বের।”
মতামত জানান